
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির।।
মানবজীবনের প্রকৃত সার্থকতা ধন- সম্পদ, ভোগ- বিলাস কিংবা ক্ষমতার মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। আসল পরিচয় নিহিত নৈতিকতা, সততা, আদর্শ ও চরিত্রে। একজন মানুষ যদি ধনী হয়, ক্ষমতাবান হয় কিংবা বিদ্যা শিক্ষায় উচ্চতায় পৌঁছায়, কিন্তু তার চরিত্র কলুষিত হয়, যদি সে মিথ্যা, প্রতারণা, অন্যায় ও অবিচারে লিপ্ত থাকে, তবে, তার জীবন কথনোই মহান বা আদর্শবান হয়ে উঠতে পারে না। মানুষের জীবনে যে শক্তি নৈতিকতা ও আদর্শের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, তা হলো ধর্ম। ধর্ম মানুষের অন্তরে ন্যায় ও সত্যের আলো জ্বালায়, পবিত্র করে, অন্যায় থেকে দূরে রাখে এবং সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও মানবিকতার বীজ বপন করে। তাই জীবনকে সার্থক ও শান্তিময় করতে হলে ধর্মের নীতি ও আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করাই একমাত্র পথ।আজকের পৃথিবীতে আমরা প্রযুক্তি, বিজ্ঞানের অগ্রগতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক উত্থানে বিস্মিত হই। কিন্তু ,প্রশ্ন হলো-এই উন্নয়ন কি আমাদের জীবনে শান্তি নিয়ে এসেছে? দুঃখজনকভাবে এর উত্তর অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘না’। আজ পৃথিবীতে যুদ্ধ, সহিংসতা, দুর্নীতি, প্রতারণা, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ ও অনৈতিকতার বিস্তার ঘটছে। পরিবারের ভেতরে ভাঙন, সমাজে বিভাজন এবং রাষ্ট্রে স্বজনপ্রীতি ও অবিচার বেড়েই চলেছে। এই অবক্ষয়ের মূল কারণ হলো আমরা ধর্মের নীতি ও আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছি। ধর্ম কোনো সংকীর্ণ গতির শিক্ষা দেয় না। ধর্ম দেয় সর্বজনীন সত্যের শিক্ষা। ইসলাম মানুষকে বলে- ‘তোমাদের মধ্যে সেই বাক্তি উত্তম “যার চরিত্র উত্তম”।হিন্দু ধর্ম শেখায়, সত্যিই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়, খ্রিস্টধর্মের বাণীর ক্ষমা ও ভালোবাসার কথা প্রচার কবে, বৌদ্ধধর্ম শান্তি, অহিংসা ও করুণার শিক্ষা দেয়। সব ধর্মের মূল বার্তাই হলো-সততা, ন্যায়পরায়ণতা, দয়া, মানবিকতা ও সহমর্মিতা। অথচ মানুষ ধর্মকে যখন কেবল আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ রাখে তখনই প্রকৃত উদ্দেশ্য পূর্ণতা পায় না। ব্যক্তিজীবনে ধর্মের আদর্শের প্রভাব গম্ভীর। একজন ব্যবসায়ী যদি ধর্মীয় নীতির আলোয় ব্যবসা করে, তবে সে ভেজাল দেবে না, মিথ্যা বলবে না, অন্যায় মুনাফা করবে না। একজন কর্মচারী যদি ধর্মীয় শিক্ষা ধারণ করে, তবে সে ঘুষ খাবে না, দায়িত্বে অবহেলা করবে না। একজন শিক্ষার্থী যদি ধর্মের অলোয় বড় হয়, তবে সে নকল করবে না, প্রতারণা করবে না এবং সৎ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।ব্যক্তিজীবনে ধর্মের এই প্রভাব পরিবার ও সমাজকে সুস্থ ও সুন্দর করে তোলে। পরিবার হলো সমাজের ভিত্তি। পরিবারে ধর্মীয় মূল্যবোধ থাকলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মজবুত হয়, সন্তানরা সৎ ও দয়িত্বশীল হয়ে বেড়ে ওঠে, বয়োজ্যেষ্ঠরা সম্মান পায়। ধর্ম শেখায় পারিবারিক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা , দায়িত্বশীলতা অথচ যখন পরিবার থেকে ধর্মীয় শিক্ষা হারিয়ে যায়, তখন যেখানে ঝগড়া-বিবাদ, অবিশ্বাস ও অশান্তি জন্ম নেয়। সমাজের অবক্ষয়ের মূল শেকড়ও অনেক সময় এই পারিবারিক অবক্ষয়ের ভেতর থেকে সৃষ্টি হয়। সুতরাং সু-শৃঙ্খল, সুন্দর,শান্তিময়, আলোকিত ব্যক্তি , সমাজ,পরিবারে ধর্মের চর্চা অপরিহার্য।সমাজ জীবনে ধর্মের শিক্ষা শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা দেয়। ধর্ম মানুষকে শেখায়-সহাবস্থান, সহনশীলতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের। সমাজে যদি ধর্মের মর্মকথা প্রতিফলিত হয়, তবে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, সহিংসতা হবে না। কিন্তু, যখন ধর্মকে বিভাজনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তখন সংঘাত সৃষ্টি হয়। অথচ প্রকৃত ধর্ম কখনো সংঘাত চায় না। ধর্ম সব সময় ঐক্য ও মানবতার শিক্ষা দেয়। রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মীয় নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। শাসকরা যদি ধর্মীয় আদর্শ ধারণ করেন, তবে তারা জনগণের সেবক হবেন, শোষক নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়-ইসলাম পূর্ব যুগে নবী, রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামগণ যখন ধর্মীয় নীতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, তখন জনগণ শান্তি, উন্নয়ন ও নিরাপত্তা পেয়েছে। কিন্তু শাসকরা যখন ধর্মকে উপেক্ষা করেছেন কিংবা ভোগবাদে মগ্ন হয়েছেন, তখনই সমাজে বিশৃঙ্খলা, অশান্তি বেড়েছে।ধর্মীয় মূল্যবোধে গড়ে উঠলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আলোকিত হবে। আজকের তরুণরাই আগামী দিনের রাষ্ট্র ও সমাজের নেতৃত্ব দেবে। তাই পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং সামাজিক জীবনে তরুণদের ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে। বাস্তব জীবনে, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষাতে হবে সততা, ন্যায়, নৈতিকতা ও মানবিকতা।ধর্মের নীতি যদি বাড়ি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে শান্তি ,উন্নয়ন ও সম্প্রীতি আসবেই। ধর্ম কেবল আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ধর্ম হলো মানুষের অন্তরের শক্তি, যা তাকে সত্য, ন্যায়, নীতি, সহমর্মিতা ও মানবতার পথে চালিত করে ব্যাক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র- এসব যদি ধর্মের নীতি ও আদর্শে পরিচালিত হয় , তাহলে পৃথিবী হবে শান্তিময়, উন্নত ও মানবিক।ধর্মের আদর্শে গড়া জীবনই পারে মানুষকে প্রকৃত মানুষে রূপান্তরিত করতে এবং সমাজে সত্যিকারের শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে, এখনই আসুন-ধর্মের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে,তা হৃদয়ে ধারণ করি এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করি,আমিন।।
লেখক: গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির, ধর্ম ও সমাজ সচেতন লেখক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপস্থাপক ও চেয়ারম্যান – গাউছিয়া ইসলামিক মিশন, কুমিল্লা এবং সিনিয়র সহ-সভাপতি বুড়িচং প্রেস ক্লাব, কুমিল্লা।।০১৭১৮২২৮৪৪৬