
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
ডিসেম্বর এলে পাড়া-মহল্লায় একটা উৎসবের আমেজ বিরাজ করত। নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজন থাকত। তরুণ-তরুণীরা ছোট ছোট জাতীয় পতাকায় চারপাশ সাজাত। সাউন্ড বক্সে দেশাত্মবোধক গান বাজত। গত দুই বছর ধরে বিজয় দিবসে সেই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের কুচকাওয়াজের মতো বড় কর্মসূচিও হচ্ছে না।
বিগত বছরগুলোতে ডিসেম্বরজুড়ে রাজধানীর শিল্প সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিভিন্ন আয়োজন ছিল চোখে পড়ার মতো। শিল্পকলা একাডেমি, টিএসসি, ধানমন্ডি লেকসহ নগরের সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণগুলোতে মাসব্যাপী মেলা, নাট্য উৎসবসহ বিভিন্ন আয়োজন লেগে থাকত।
১৬ ডিসেম্বর জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডের কুচকাওয়াজ, দিনভর সাংস্কৃতিক আয়োজন থাকত ঢাকার বিভিন্ন স্থানে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর গত বছর নিরাপত্তার কারণে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ স্থগিত করে। এ বছরও কুচকাওয়াজ স্থগিত। কেবল রাজধানী নয়, জেলা-উপজেলা পর্যায়েও কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। প্রশাসনিক সূত্রগুলো বলছে, বড় কেন্দ্রীয় সমাবেশের পরিবর্তে বিজয় দিবসের মূলমন্ত্রকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়াই অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য। এজন্য জেলা-উপজেলায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিজয় মেলাসহ নানা আয়োজন থাকছে। এই নীতির অংশ হিসেবে ৬৪ জেলায় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে তিন দিনব্যাপী বিজয় মেলার আয়োজন করা হয়েছে। প্রায় সব উপজেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা ও স্মরণানুষ্ঠান হচ্ছে। স্কুল ও কলেজগুলোতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্রাঙ্কন, রচনা ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা আয়োজনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও তরুণদের যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিজয় দিবসের কর্মসূচি সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা নিবেদন, তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের সূচনা এবং সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ের উদযাপন সীমাবদ্ধ রয়েছে। আগের মতো রাজধানীতে একাধিক বড় মঞ্চ, ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা বা সপ্তাহ বা মাসব্যাপী কেন্দ্রীয় উৎসবের দেখা মেলেনি। তবে এবার সর্বাধিক পতাকা উড়িয়ে প্যারাসুটিং করে বিশ্বরেকর্ড গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।সরকারি ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, বিজয় দিবসকে ‘ঢাকাকেন্দ্রিক উৎসব’ থেকে বের করে এনে দেশব্যাপী জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই এই নীতির উদ্দেশ্য। একই সঙ্গে প্রশাসনিক ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা সহজ করা এবং স্থানীয় সংস্কৃতিকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে। তবে এই পরিবর্তন নিয়ে ভিন্ন মতও রয়েছে। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকায় বড় কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সমাবেশের সংখ্যা গড়ে তিন থেকে পাঁচটি থাকলেও এ বছর তা একটি, তাও সীমিত পরিসরে। পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের আয়োজনেও। আগে পাড়া-মহল্লায় অনেক আয়োজন সাপ্তাহিক, পাক্ষিক কিংবা মাসব্যাপী হতো। সেখানে ঢাকার অনেক জায়গায় তা হচ্ছে না। কোথাও হলেও তার পরিসর আর সময়সীমা কমে গেছে। এতে স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিল্পী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়োজনেও পরিবর্তনের এই প্রবণতা স্পষ্ট। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ছয় থেকে সাতটি অনুষ্ঠান হতো। সেখানে ২০২৫ সালে তা নেমে এসেছে তিনটিতে। বাংলা একাডেমি ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আয়োজনের সংখ্যা কমেছে, যদিও ধারাবাহিকতা বজায় রেখে স্মরণানুষ্ঠান ও আলোচনা কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো মনে করছে, জাতীয় দিবসের ঐতিহ্যগত কেন্দ্রীয় আয়োজন কমে যাওয়ায় রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার জৌলুস কিছুটা ম্লান হয়েছে। হয়রানি এড়াতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নাট্যকর্মী জানান, সারাদেশে বিজয় উৎসবের পরিধি ভিন্ন ব্যাখ্যাসহ মবের আশঙ্কায় গত বছর থেকে যে রকম দায়সারাভাবে উদযাপিত হলো, তা উদ্বেগের। এই ধারা আগামী দিনে স্থায়ী রূপ নেবে, নাকি আবারও কেন্দ্রীয় জৌলুসে ফিরে যাবে– তা নির্ভর করবে রাষ্ট্রীয় নীতি ও জনআকাঙ্ক্ষার সমন্বয়ের ওপর। এই ধারা বজায় থাকলে নতুন প্রজন্ম বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় হওয়া মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস না জেনে শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্যারেড আয়োজন না করার ক্ষোভে গণকুচকাওয়াজ আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্য। গতকাল সোমবার সংগঠনটি জানিয়েছে, রাষ্ট্র যদি পিছিয়ে যায়, জনগণই সামনে আসবে।এ বিষয়ে সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।