শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার উদ্যোগ শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার উদ্যোগ কুমিল্লার খবর কুমিল্লার খবর Cumillarkhobor প্রকাশিত: ৬:০৩ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২১, ২০২৪ শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার উদ্যোগ ড. মো. আবদুল বাকী চৌধুরী নবাব,ঢাকা।। কয়েক দিন ধরে পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমসহ অফিস-আদালত, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ইত্যাদিতে সবার মুখে মুখে একটি কথা, ইন্টারপোল। জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তাকে গ্রেফতারের জন্য রেড অ্যালার্ট নোটিস চেয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শকের মাধ্যমে ইন্টারপোলকে চিঠি দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। অবশ্য এ ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, ফেরত দিতে না চাইলে কোনো দেশ যেকোনো অজুহাত দেখিয়ে আবেদন নাকচ করতে পারে। শেখ হাসিনাকে চুক্তির মাধ্যমে কিংবা ইন্টারপোলকে দিয়ে ফেরত পাওয়ার বিষয়টি অনেক জটিল বলে মনে হয়। বস্তুত আইনভিত্তিক রায় এবং এর প্রয়োগ বিচারব্যবস্থার পরিব্যাপ্তি দিনে দিনে বিশ্বজনীন হয়ে পড়ছে। আসলে মানুষ অনেক সময় পশুর বৈশিষ্ট্যেরও নিচে নেমে যায়। তখন তার কাছে আপন-পর বলে কিছু আর থাকে না। আর এই সময় যেকোনো অন্যায় করতে দ্বিধাবোধ করে না। এমনকি ধর্মীয় অনুশাসনও মানে না। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন, এটি আদিম প্রবৃত্তি। আবার কেউ বলেন, এটি সম্পূর্ণ পরিবেশগত। এর মধ্যে মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ যখন কোনো অন্যায় করে, তখন মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করে না। কেননা মানুষের মন এত জটিল ও রহস্যজনক যে এর হদিস এখনও মেলেনি। আদিকাল থেকে শাসন ও বিচারব্যবস্থা সমান্তরালভাবে চলে আসছে। স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একজন দুর্বৃত্ত যখন কোনো জঘন্য অন্যায় করে তখন পরিণাম চিন্তা করে না। আর ঘটনা ঘটানোর পর অপরাধবোধ জাগে এবং তার ভেতর অনুশোচনাও আসে। অথচ তখন আর সময় থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ করলেও কোনো কোনো ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে অপরাধবোধও জাগে না। এ ক্ষেত্রে জুরিস্প্রুডেন্স ছাড়ার পাত্র নয়। এটি তার মতো করে আইনের মাপকাঠি নিয়ে এগিয়ে এসে থাকে। এদিকে অপরাধী যতই কঠিন ও শক্তিশালী হোক না কেন, প্রায় ক্ষেত্রে কৃতকর্মের জন্য পরবর্তীতে ভীত হয়ে পড়ে। অনেক সময় জীবন ভয়ে ভীত হয়ে দেশান্তরিত হয়; অর্থাৎ অন্য কোনো দেশে পালিয়ে যায়। এদিকে সংঘটিত অপকর্মের প্রকারভেদ আছে। আর সেই আবর্তে অনেকের রাজনৈতিক আশ্রয়ের কথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু কতগুলো অপরাধ আছে, যা ক্ষমার অযোগ্য। অতীতে কোনো অপরাধী অন্য দেশে পালিয়ে থাকলেও তখন তেমন বিবেচনায় আনা হতো না। কিন্তু এর মাইলফলক সৃষ্টি হয় ১৯২৩ সালের দিকে।এখানে উল্লেখ্য যে, দেশের শাসন এবং বিচারব্যবস্থা দুটি ভিন্ন ধারায় চললেও একে অন্যের সম্পূরক হিসেবে বিদ্যমান। বিচারব্যবস্থা এককভাবে চলতে পারে না। যদি প্রশাসন তার লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়ে এগিয়ে না আসে যেমন-পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা, সাক্ষীসাবুদ, জেলখানা ইত্যাদি। প্রতিটি দেশের সংবিধান মতে বিচারকের ক্ষমতা অপরিসীম। অনেক সময় টপ প্রশাসনকেও কৃতকর্মের জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। এর স্বপক্ষে ভূরি ভূরি বাস্তব উদাহরণ আছে, যা অতীতেও ছিল, এখনও আছে এবং আগামীতেও থাকবে। আপনারা হয়তো বিচারকের পরিচ্ছেদের দিকে লক্ষ্য করেছেন যে বিচারকের মাথায় বৃদ্ধা জননীর পরচুলা, বো-টাই, কালোকোর্ট, লম্বা হাতা ইত্যাদি। আর এই যে কালো কোট বা জামার হাতা লম্বা। এর পেছনে কথা হলো দোষী ব্যক্তি যতই ক্ষমতাধর বা আত্মগোপন করে অন্য দেশে পালিয়ে থাকুক না কেন, ওই প্রতীকী লম্বা হাতা ভিন্ন দেশ থেকে ধরে নিয়ে আসতে সক্ষম। আর এ ক্ষেত্রে সাহায্য করে থাকে পলায়নরত দেশের প্রশাসনিক শক্তি হিসেবে পুলিশ ফোর্স। আর এটিতে চলমান মামলায়ও হতে পারে। আবার তামাদি আইনের আওতায়ও হতে পারে। তবে তামাদি আইনের ক্ষেত্রে ৫ নং ধারার আলোকে ফরিয়াদিকে বিলম্ব হেতু যুক্তিতর্ক দিয়ে পুনরায় বোঝাতে হবে। নতুবা এটি তামাদিই থেকে যাবে।বিদেশের কোনো দেশে পলায়নকৃত আসামির ব্যাপারে দ্বিপক্ষীয়ভাবে চুক্তি থাকলে তখন তাকে ধরে আনার ব্যাপারে দুই দেশের পুলিশ ফোর্স সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকে। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় চুক্তি না থাকলে তখন ইন্টারপোলের কথা উঠে আসে। ইন্টারপোল হলো পুলিশ বাহিনীর একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। ১৯২৩ সালের দিকে প্রায় বিশ্বের ৫০টি দেশ মিলে পুলিশ বিভাগকে আধুনিকীকরণ এবং অপরাধীদের দ্রুত চিহ্নিত ও ধরার লক্ষ্যে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় এই আন্তর্জাতিক সংগঠনটি গড়ে তোলে। তবে ইন্টারপোলের সদর দফতর ফ্রান্সের লিওনে অবস্থিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাজনৈতিক কারণে কয়েক দিন এর কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও ১৯৪৬ সাল থেকে পুনরায় কার্যক্রম শুরু হয়। আর ইন্টারপোলের একটি সাধারণ পরিষদ রয়েছে। এর অধিবেশন একেক সময় একেক সদস্য রাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মূলত সদস্য রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে ত্বরিত যোগাযোগ স্থাপন, অপরাধীদের সন্ধান, গতিরোধ, গ্রেফতার ইত্যাদির জন্য এই সংগঠন তথা কমিশনের যোগাযোগব্যবস্থাসহ বিভিন্ন আঙ্গিকে কার্যক্রম চলে থাকে।বর্তমানে এর সদস্য রাষ্ট্র ১৯৬টি। এদিকে বাংলাদেশ ইন্টারপোলের সদস্যপদ লাভ করে ১৯৭৬ সালে। আসলে এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো, পুলিশ বিভাগ বা পুলিশ বাহিনীকে অপরাধীদের ধরার ব্যাপারে পারস্পরিক সহযোগিতা করা; আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে আপ-টু-ডেট জ্ঞান ও প্রযুক্তির বিনিময় করা; এক দেশের অপরাধী অন্য দেশে যাতে সহজে গা ঢাকা দিতে না পারে সে ব্যাপারে পারস্পরিক সহযোগিতা করা; সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্ত কোনো আসামিকে স্বদেশে ফেরত দান; অপরাধ অনুসন্ধানের ব্যাপারে পারস্পরিক সহযোগিতা করা; বিশ্বের অপরাধ দমন জোরদার করা এবং বিশ্বজনীন নাগরিক জীবনে শৃঙ্খলা রক্ষা করা ইত্যাদি। ইন্টারপোলের বাস্তব ভূমিকা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। এ ক্ষেত্রে ইন্টারপোল অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং যুগপৎ ইন্টারপোল এই বিশ্বে একটি সম্মানজনক অবস্থায় বিরাজ করছে। অনেকে দুই বা ততোধিক দেশের পাসপোর্টধারী। এর মধ্যে কিছু আত্মকেন্দ্রিক ও সুবিধাবাদী ব্যক্তি অপকর্ম করে থাকে। আর তারা চিন্তা করে যে, সমস্যা বাধলে অন্য দেশের পাসপোর্ট দিয়ে বিদেশ পাড়ি জমাবে। কিন্তু এখন কিছু না হলেও পরবর্তীতে নিস্তার পাবে কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কেননা ঘুমন্ত সিংহের ন্যায় ইন্টারপোল চুপচাপ বসে প্রত্যক্ষ করে থাকে। সুযোগ মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। আরও একটি কথা সবারই জানা উচিত যে মৃত্যুর পরেও বিচার হয়, যা মাঝেমধ্যে পত্র-পত্রিকায় দেখে থাকবেন।বাংলাদেশ ও ভারত প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলায় আসামি ও বন্দিদের একে অন্যের কাছে হস্তান্তরের জন্য ২০১৩ সালে একটি চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তির নামে মামলা বা অভিযোগ দায়ের হয় বা তিনি দোষী সাব্যস্ত হন অথবা দেশের আদালত কর্তৃক প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ করার জন্য তাকে ফেরত চাওয়া হয়, তা হলে তাকে ফেরত দেবে বাংলাদেশ ও ভারত। চুক্তিতে আরও বলা আছে যে, অপরাধটি রাজনৈতিক প্রকৃতির হলে যেকোনো দেশ প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। তবে চুক্তি অনুযায়ী হত্যা, নরহত্যা বা অপরাধমূলক হত্যা, আক্রমণ, বিস্ফোরণ ঘটানো, জীবন বিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বিস্ফোরক পদার্থ বা অস্ত্র তৈরি বা নিজের কাছে রাখাসহ বেশ কিছু অপরাধকে রাজনৈতিক বলার সুযোগ নেই। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি ২০১৩ সালে হলেও ২০১৬ সালে মূল চুক্তিটিতে একটি ধারা সংযোজন করে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া আরও সহজ করা হয়।সাধারণত সন্দেহভাজন ব্যক্তির যাবতীয় তথ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশকে আবেদন করতে হয় রেড নোটিস জারির জন্য। রেড নোটিস ছাড়াও সাত ধরনের হয়ে থাকে ইন্টারপোলের সমন। বস্তুত রেড নোটিসকে এই সংস্থাটির আন্তর্জাতিক গ্রেফতারি পরোয়ানার সমতুল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ব্যবস্থায় মুহূর্তের মধ্যে ১৯৬টি সদস্য রাষ্ট্রের পুলিশের কাছে চলে যায় অপরাধীদের অপরাধ, সবশেষ অবস্থান এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য। ইন্টারপোলের কাছে প্রত্যর্পণ, আত্মসমর্পণ বা অনুরূপ আইনি পদক্ষেপের জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে এবং সাময়িকভাবে গ্রেফতার করার জন্য ইন্টারপোল রেড নোটিস জারি করে। তবে এই সংস্থা রাজনৈতিক, সেনা সম্পর্কিত, ধর্মীয় ও জাতিগত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে না। অপরাধ করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের নাম ইন্টারপোলে পাঠানো ও তদারকির দায়িত্ব পালন করে ঢাকার পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। তা হলে বাংলাদেশ কেন সেই চুক্তি অনুযায়ী ফেরত না চেয়ে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাচ্ছে সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ১৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কাজ শুরু হওয়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। আগামী ১৮ নভেম্বরের মধ্যে শেখ হাসিনাসহ পলাতকদের আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।ইন্টারপোলের হালনাগাদ তালিকায় দেখা যায়, ১৯৬টি সদস্য দেশের ৬ হাজার ৬৬৮ জনের নাম ঝুলছে ইন্টারপোলের রেড নোটিস বোর্ডে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আছে ৬৪ জন। এর মধ্যে অনেককেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি বিধায় ইন্টারপোলের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন আছে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের। তবে বাংলাদেশে একটি বড় নজির আছে যে, রেড নোটিস জারির পর ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৫ জনকে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি অপরাধ ও বিভিন্ন হত্যা মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি। এদিকে ইন্টারপোল কারও বিরুদ্ধে একবার রেড নোটিস জারি করলে সেটি সংস্থাটির সদস্যভুক্ত ১৯৬টি দেশের কাছে পাঠানো হয়। মূলত ইন্টারপোলের এমন একটি ডাটাবেজ রয়েছে, যেখানে অপরাধীদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য যেমন-অপরাধীর ছবি বা স্কেচ, ক্রিমিনাল প্রোফাইল, ক্রিমিনাল রেকর্ড, চুরির রেকর্ড, চুরি যাওয়া পাসপোর্ট, যানবাহন এবং জালিয়াতির তথ্য ইত্যাদি পাওয়া যায়। দুর্নীতি, যুদ্ধাপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, মানব পাচার, অস্ত্র পাচার, মাদক পাচার, সাইবার ক্রাইম, মানি লন্ডারিং, শিশু সহিংসতাসহ ১৭ ক্যাটাগরির অপরাধ তদন্তে ইন্টারপোল তার সদস্য দেশগুলোকে সহায়তা দিয়ে থাকে। এ পরিস্থিতিতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে পলাতক শেখ হাসিনাকে বর্তমান অবস্থান ভারত থেকে ফেরত আনা সম্ভব কি না সেটাই প্রশ্ন। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলুক, তা সবারই কাম্য। ড. মো. আবদুল বাকী চৌধুরী নবাব সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় SHARES জীবন-যাপন বিষয়: শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার উদ্যোগ