কুমিল্লা-নোয়াখালী ৫৯ কিলোমিটার মহাসড়কের গলার কাঁটা ৮ কিলোমিটার!
লাকসাম প্রতিনিধি।।
কুমিল্লা-নোয়াখালীর আঞ্চলিক মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্প শেষ হলেও লাকসাম ও লালমাই উপজেলার আট কিলোমিটার অংশে দুই লেনই রয়ে গেছে। এতে নিয়মিত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের যাত্রীদের।
কুমিল্লার দক্ষিণাঞ্চল, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দাদের সড়ক যোগাযোগের একমাত্র পথ কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়ক। যাতায়াতে সময়, পরিবহন খরচ ও যানজটের ভোগান্তি কমানোর প্রচেষ্টা হিসেবে, কুমিল্লার নগরীর টমছমব্রিজ এলাকা থেকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ পর্যন্ত ৫৯ কিলোমিটারের এ মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল।সে মোতাবেক, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে মহাসড়কটির চার লেনে উন্নীতকরণের কাজ শুরু হয়। পরে দুই দফা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০২৩ সালের জুন মাসে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ওই বছরের সেপ্টেম্বরে সাত কিলোমিটার সড়কের কাজ বাকি রেখেই প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করে সড়ক ও জনপদ বিভাগ।
পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বলছেন, নির্বিঘ্নে ও নিরাপদ যাত্রার ৫৯ কিলোমিটারের এ রাস্তাটির আট কিলোমিটার এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জটিলতা কাটিয়ে দ্রুত মহাসড়কের প্রকল্প শেষ করার দাবি তাদের।
কুমিল্লা সড়ক ও জনপদ বিভাগ বলছে, ‘ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার’ কারণে লাকসাম পৌর এলাকার দৌলতগঞ্জের ৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার, লালমাই উপজেলার শানিচো এলাকার ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার এবং একই উপজেলার লালমাই বাগমারা বাজার এলাকার ১ দশমিক ৭ কিলোমিটার সড়কের অংশ চার লেনে উন্নীত করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই মেগা প্রকল্পের সুফল কুমিল্লা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর অঞ্চলের সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারছে না।এই মহাসড়কের লাকসাম বাজার-শানিচো-বাগমারা এলাকায় স্বাভাবিক সময়েই যানজট লেগে থাকে। লাকসাম-বাগমারা এলাকায় যানজট সহ্য করতে হবে, এমনটা মেনেই বাড়ির পথ ধরতে হয় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মানুষজনকে। কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার জংশন এলাকার বাসিন্দা আবু বকর জাহিদ বলেন, “মহাসড়কটি চার লেন করে কোনো লাভই হয়নি। যে এলাকাগুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো চার লেনে উন্নীত না হওয়ায় হাজার হাজার কোটি টাকা সরকারি অর্থ খরচের পরেও সুবিধা পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ।
বাগমারা এলাকার মাওলানা ছানা উল্লাহ বশারী বলেন, “দিন দিন ঢাকা-কুমিল্লা-নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর এই পথে যানবাহন বাড়ছে। বাগমারা এলাকাতেও যানজট তীব্র হচ্ছে। মহাসড়ক চার লেন করার দাবিতে কয়েক দফায় মানববন্ধন করেও লাভ হয়নি।”
নোয়াখালী জেলার বাসিন্দা উপকূল বাসের যাত্রী সালমা আক্তার বলেন, লালমাই উপজেলার বাগমারা বাজারে যে যানজট হয়, তা বলার বাইরে। কারণ আশপাশে যাওয়ার মত কোনো জায়গায়ও নেই। তার ওপর সেখানে রাস্তার উপরই অনেক দোকানপাট বসে, ফুটপাতও নেই যে মানুষ হাঁটবে। যদি সেখানে পুলিশের কঠোরতা থাকে তাহলে উপকার হবে।”
লাকসাম এলাকার বাসিন্দা আবদুল হান্নান বলেন, “লাকসাম বাইপাস ও লাকসাম বাজার এলাকাটি খুবই জনবহুল এলাকা। এখান থেকে নোয়াখালী-লক্ষ্মীপুর ছাড়াও কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ ও চৌদ্দগ্রামের মানুষ যাতায়াত করে। দূরপাল্লার যানবাহনের পাশাপাশি এখানে মাইক্রোবাস, লেগুনা, অটোরিকশা স্ট্যান্ডও রয়েছে।যানবাহনে যাত্রী ওঠানামার কারণে এখানে স্বাভাবিক যান চলাচল ব্যাহত হয় এবং যানজটের সৃষ্টি হয়।
সরজমিনে দেখা গেছে, লাকসাম উপজেলার জংশন এলাকা থেকে শুরু করে দক্ষিণ বাইপাস পর্যন্ত মহাসড়কটি অতিক্রম করা চালক ও যাত্রীদের জন্য সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণার।মহাসড়ক চার লেন থেকে দুই লাইনে পরিণত হওয়ায় এই অংশে প্রতিনিয়ত যানজট লেগেই থাকে। ৫ থেকে ১০ মিনিটের রাস্তা পার হতে কখনও কখনও দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে।
লাকসাম উপজেলার সবচেয়ে জনবহুল এই এলাকাটি বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা বলে বিবেচিত।মহাসড়কের উপর লালমাই বাগমারা বাজারটিও উপজেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা। মহাসড়কের এ অংশে চার লেন না হওয়ায় যানজটে অতিষ্ঠ চলাচলকারীরা। আর শানিচো যে এলাকাতে চার লেন উন্নত করা সম্ভব হয়নি, সেটি এখন দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় পরিণত হয়েছে। অনেক দ্রুতগামী যানবাহন চার লেনে চলাচল করে এসে হঠাৎ দুই লেনের সরু সড়কে এসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে। ঢাকা-নোয়াখালী পথে চলাচলকারী হিমাচল পরিবহনের বাস চালক হানিফ সরকার বলেন, এত টাকা খরচ করে লাভ কি হল? যদি এখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে পড়ে থাকতে হয়।একই বাসের যাত্রী আবদুস সবুর বলেছিলেন, “সড়ক ও জনপদ বিভাগ এবং প্রশাসনের আন্তরিকতার অভাবের কারণে এত বড় প্রকল্পটির সফলতা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আগে লাকসাম ও বাগমারা এলাকায় রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেও এখন তো সেটি নেই। তাই আমরা আশা করছি, এই জায়গাগুলোর কাজ দ্রুত আবার শুরু হবে।”কুমিল্লা সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, “কুমিল্লা-নোয়াখালী মহাসড়কের লালমাই শানিচোঁ এলাকার কাজ থেমে আছে আইনি জটিলতার কারণে। ভূমি অধিগ্রহণ ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত একটি রিট রয়েছে হাই কোর্টে। সে বিষয়টি নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। আদালত থেকে নির্দেশনা পেলেই সেখানে কাজ শুরু করা যাবে। অধিগ্রহণকালীন স্থানীয় ভূমির মালিক অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার গং হাই কোর্টে এই রিট করেন।“এই এলাকাটিতে অধিগ্রহণযোগ্য ভূমিতে খুব বেশি স্থাপনা নেই। বেশিরভাগই খালি এবং আবাদি জমির অংশ। সেখানে আইনি জটিলতা শেষ করা গেলে কাজ খুব দ্রুত আগানো যাবে।” বাগমারার বিষয়ে এই প্রকৌশলী বলেন, “বাগমারা এলাকায় জমি অধিগ্রহণ নিয়ে আপাতত কোনো আইনি জটিলতা নেই। সেখানে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ দ্রুত শুরু করা যাবে। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা পেলেই কাজ শুরু হবে। বাগমারায় সড়কের দুই পাশেই ভবন রয়েছে। বেশির ভাগই বাণিজ্যিক স্থাপনা। এ ছাড়া কাঁচা বাজারের কিছু অংশও রাস্তার পাশে।লাকসাম প্রসঙ্গে প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, “লাকসাম এলাকায় মহাসড়কের নির্ধারিত এ্যালাইনমেন্টে অনেক স্থাপনা রয়েছে। সেগুলো ভেঙে ভূমি অধিগ্রহণ করলে অনেক টাকা ব্যয় হতো এবং সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতিও বিবেচ্য ছিল। যে কারণে মূল পরিকল্পনা থেকে সরে এসে এই জায়গায় আরও একটি বাইপাস সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয় এবং ওই অংশটুকু প্রজেক্ট থেকে বাদ দেওয়া হয়। নতুন প্রকল্প করে সেখানে চার লেনের বাইপাস করা হবে।”
তবে এসব কাজ কবে নাগাদ শুরু হবে, তার সঠিক কোনো ধারণা দিতে পারেননি সড়ক ও জনপথ বিভাগের কোনো কর্মকর্তা।কুমিল্লা সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীত চাকমা বলেন, “সব জটিলতা নিরসন সংক্রান্ত প্রস্তাবনা আমরা সড়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয় থেকে যে সিদ্ধান্ত দেবে, সে মোতাবেক কাজ করা শুরু করবো।
প্রকাশক ও সম্পাদক
মোঃ সাইফুল ইসলাম ফয়সাল
মোবাইলঃ +৮৮০১৭৭৫৭২৬৬৭৯/+৮৮০১৭৬৫৭৭৮৪৪৬
ই-মেইলঃ cumillarkhobor33@gmail.com